প্রকাশিত: Sat, Apr 15, 2023 4:10 PM
আপডেট: Tue, Jun 24, 2025 4:11 PM

বড় নেতা হতে হলে আত্মা বড় হতে হয়

অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন : ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বয়স যখন ৩০ তখন তিনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপন করেন। ফজলে হাসান আবেদের বয়স যখন ৩৬ তখন তিনি ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেন। অধ্যাপক মুাহম্মদ ইউনূসের বয়স যখন ৪৩ তখন তিনি গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। ভাবা যায়? আমিও আজ অনেক বছর যাবৎ একটি ইনস্টিটিউট করার কথা ভাবছিলাম। আমার বয়স ৬০ ছুঁই ছুঁই করছে। স্বপ্ন কি তাহলে স্বপ্নই থেকে যাবে? অথচ এই বাংলাদেশের সত্যিকারের উন্নয়নের বীজ বপিত হতো একটি বিশ^মানের ইনস্টিটিউট স্থাপনের মাধ্যমে। যেখানে দেশি-বিদেশি শতশত বিজ্ঞানী বিশ^মানের পরিবেশে গবেষণায় নিয়োজিত থাকবে। শেষ করি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার সূচনা লগ্নের একটি গল্প দিয়ে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে আহত যোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য গড়ে তোলা হয়েছিল এই প্রতিষ্ঠানটি। তবে শুরুতে এর নাম ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ দেওয়া হলেও ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন এ হাসপাতালের উদ্যোগ নেওয়ার সময় নাম নিয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আপত্তি আসে। 

সেই সময় বিষয়টি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কান পর্যন্ত পৌঁছায়। ডা. জাফরুল্লাহ সচিবালয়ে গিয়ে দেখা করেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেদিনের কথোপকথন ‘মুজিব ভাই, বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল করতে দেওয়া হচ্ছে না’ জানালেন ডা. জাফরুল্লাহ। ‘বাংলাদেশ নাম থাকলে কেমন সরকারি সরকারি মনে হয়। অন্য কোনো সুন্দর নাম ঠিক কর হাসপাতালের জন্যে’ বললেন বঙ্গবন্ধু। অনেক তর্কের পর বঙ্গবন্ধু বললেনÑ ‘তুই তিনটি নাম ঠিক করবি। আমি তিনটি নাম ঠিক করবো। দুজন বসে যে নাম ভালো মনে হবে সেই নামে হাসপাতাল হবে’। তিনটি নাম ঠিক করে আবার বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ‘বল, কী নাম ঠিক করেছিস’? বঙ্গবন্ধু জানতে চাইলে ডা. জাফরুল্লাহ বলতে শুরু করলেন, [১] বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল [২] গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। 

তৃতীয় নামটি বলার সুযোগ না দিয়ে বঙ্গবন্ধু বললেনÑ ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র খুব সুন্দর নাম। এই নামেই হবে হাসপাতাল। এই হাসপাতালে শুধু চিকিৎসা হবে না। দেশটাকে গড়ে তুলতে হবে। স্বাস্থ্য, কৃষি, শিক্ষা সবকিছু নিয়ে কাজ করতে হবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে’। জোহরা বেগম, পাকিস্তান সরকারের যুগ্ম সচিব এম এ রব ও ডা. লুৎফর রহমান সাভারে তাদের পারিবারিক সম্পত্তি থেকে পাঁচ একর জায়গা দিয়েছিলেন হাসপাতালের জন্য। বঙ্গবন্ধু আরও ২৩ একর জমি অধিগ্রহণ করে দিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ নাম পরিবর্তিত হয়ে ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ নামে যাত্রা শুরু করল ১৯৭২ সালে। (তথ্যসূত্র: ঢাকা পোস্ট) ঠিক তেমনি ভারতের সেরা দুটি ইনস্টিটিউট যেমন টাটা ইনস্টিটিউট বা আইআইএসসি পেছনেও একজন ভিশনারি বিজ্ঞানী হোমি ভাভা ও একজন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর ভূমিকা ছিল। 

১৯৪৫ সালে টাটা ইনস্টিটিউট যখন প্রতিষ্ঠিত হয় হোমি ভাভা বয়স তখন ৩৬ বছর। প্রফেসর আব্দুস সালাম যখন ইতালির ত্রিয়েস্তে শহরে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স প্রতিষ্ঠা করেন তখন তার বয়স ছিল ৩৮। প্রফেসর সালামের ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার পেছনে ছিল ইতালির সরকার, ওঅঊঅ আর ইউনেস্কো। একটি দেশে কোন বিশ্বমাপের ইনস্টিটিউট করতে হলে বঙ্গবন্ধু, জওহরলাল নেহেরু, জাতিসংঘের মত বড় মানুষ কিংবা বড় প্রতিষ্ঠান লাগে। আশা করি আমাদের রাজনীতিবিদদের যারা এখন ক্ষমতায় আছেন বা ক্ষমতায় যাবেন তারা একটি বিশ্বমানের ইনস্টিটিউট খোলার গুরুত্ব বুঝতে পারবেন। এর মাধ্যমে আমাদের প্রবাসী বড় বড় বিজ্ঞানীরা দেশের ছেলেমেয়েদের গড়ার ক্ষেত্রে অসাধারণ ভূমিকা রাখতে পারবে। তাদের সেই সুযোগটা আমাদেরকেই করে দিতে হবে। 

বঙ্গবন্ধু কিন্তু জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে বলেননি ‘তোকে আওয়ামী লীগ করতে হবে’ কিংবা জওহরলাল নেহেরু হোমি ভাভাকে বলেননি ‘তোমাকে কংগ্রেস করতে হবে’। সবাইকে দলের ছাঁচে ফেলা ঠিক না। এই যে আমাদের সরকারেরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ইনস্টিটিউটের প্রধানের পদে কেবল দলান্ধদের খুঁজে খুঁজে বের করে নিয়োগ দেন তার মাধ্যমে কি তাদের দেশপ্রেমের প্রমান মিলে? বড় নেতা হতে হলে আত্মা বড় হতে হয়। এমন বড় যেন সবাইকে ধারণ করার মত হৃদয়টা যথেষ্ট বড় হয়। শুভ নব বর্ষ। লেখক: শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়